যানজটমুক্ত ঢাকার স্বপ্ন: জুলাই থেকে নামছে ইলেকট্রিক বাস

 

রাজধানী ঢাকার সড়কে গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা, বাসের জন্য যাত্রীদের দুর্ভোগ যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানামা, অসৌজন্যমূলক আচরণ ও নিরাপত্তার সংকট সব মিলিয়ে যাত্রীদের ভোগান্তি আর ভোগান্তি। এই বাস্তবতা উত্তরণ হতে যাচ্ছে। আগামী ১ জুলাই থেকে ঢাকায় শুরু হচ্ছে নতুন রুট-ভিত্তিক গণপরিবহন প্রকল্প, যার লক্ষ্য শহরের যানবাহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং যাত্রীসেবাকে মানবিক ও যুগোপযোগী করা।

 

 

এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) । সমন্বিত এই উদ্যোগে অংশ নিচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, দুই সিটি কর্পোরেশন, বিআরটিএ ও সংশ্লিষ্ট পরিবহন সংগঠনগুলো।

 

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, “আমাদের শহরের সবচেয়ে বড় সমস্যা যাতায়াত। এই সমস্যা শুধু অবকাঠামো দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়; দরকার শৃঙ্খলা, সমন্বয় ও যাত্রীকেন্দ্রিক পরিকল্পনা। আমরা সেটাই করতে যাচ্ছি। ১ জুলাই থেকে যে প্রকল্প চালু হচ্ছে, তা পরীক্ষামূলক নয়; এর মাধ্যমে শহরের পরিবহন ব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে।”

 

উপদেষ্টা বলেন, “এই উদ্যোগে শুধু ইলেকট্রিক বাস নামানোই নয়, শহরের পরিবহন ব্যবস্থাকে সময়নিষ্ঠ, নিরাপদ ও মানবিক করা হচ্ছে। সড়কে সুশৃঙ্খল চলাচলের জন্যই রুট-ভিত্তিক মডেল এবং মালিকদের সমন্বয় প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে।”

 

 

তিনি জানান, প্রকল্পের আওতায় থাকবে নির্দিষ্ট রুট-ভিত্তিক বাস, বাস থামার নির্দিষ্ট স্টপেজ, একক ডিজিটাল টিকিটিং ব্যবস্থা, বাস মালিকদের সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম, প্রশিক্ষিত চালক ও সহকারী, বাসে সিসি ক্যামেরা ও জিপিএস ট্র্যাকিং, নারী-শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন যাত্রীদের জন্য নিরাপদ সেবা। শুরুতে ঢাকা শহরের চারটি নির্দিষ্ট রুটে এই ব্যবস্থা চালু হবে। পরবর্তী ধাপে বর্ধিত রুট অন্তর্ভুক্ত করে পুরো ঢাকা শহরে তা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।

 

 

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, “এত দিন আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন ও প্রতিযোগিতামূলক। এতে রাস্তায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হতো। এই রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেল বাস্তবায়ন হলে পরিবহন ব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত শৃঙ্খলা ফিরবে এবং নাগরিক ভোগান্তি অনেকটাই কমবে।”

 

তবে এই প্রকল্প নিয়ে কিছু শঙ্কাও রয়েছে। পরিবহন শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, মালিকদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত এবং টিকিট রাজস্ব বণ্টনের মতো ইস্যুগুলো সমাধান না হলে প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম বিপুল বলেন, “সরকারের পরিকল্পনা ভালো কিন্তু চালক-হেলপারদের মানবিক দিকটা নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক বেতন, নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণ ছাড়া এই উদ্যোগ স্থায়ী হবে না।”

 

যাত্রীরাও চাইছেন এই উদ্যোগ যেন আরেকটি অসম্পূর্ণ প্রকল্পে পরিণত না হয়।

 

মতিঝিলের কর্মজীবী নারী সোনিয়া রহমান বলেন, “বাসের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করি। যদি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট রুটে বাস চলে এবং যাত্রীদের সম্মান দিয়ে সেবা দেওয়া হয়, তাহলে এটা অবশ্যই বড় পরিবর্তন হবে।”

 

নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ মেগাসিটিতে কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। ১ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া প্রকল্পটি সফল হলে এটি হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোর জন্য একটি রোল মডেল।

 

ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মনিরুল ইসলাম বলেন, “ইলেকট্রিক বাস খুব ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এটা যেন কয়েক মাস পর বন্ধ না হয়ে যায়। পুরোনো অভিজ্ঞতায় আমাদের অনেক হতাশা জমে আছে।”

 

তিনি বলেন, “ঢাকায় বহু প্রকল্প এসেছে, কিছু শুরু হয়ে হারিয়ে গেছে, কিছু আর বাস্তবায়নই হয়নি। তবে এই বিদ্যুৎচালিত গণপরিবহন প্রকল্প, সরকারি উচ্চপর্যায়ের সমন্বয়, আন্তর্জাতিক অর্থায়ন, এবং প্রযুক্তিনির্ভর রূপরেখাসব মিলিয়ে এই উদ্যোগে বাস্তব পরিবর্তনের সম্ভাবনা অনেক বেশি। শহর যেমন তার রাস্তা ও যানবাহনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, তেমনি তার স্বপ্ন ও সংগ্রামের ছাপ পড়ে সেখানেও। ১ জুলাইয়ের নতুন সুচনা হবে এটা প্রত্যাশা।”

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার বায়ু দূষণের অন্যতম বড় উৎস হলো পুরোনো ডিজেলচালিত বাস। ইলেকট্রিক বাস চালু হলে শুধু শহরের যান চলাচল নয়, বাতাসও হবে পরিচ্ছন্ন।

 

পরিবেশ গবেষক ড. ফারজানা কবির বলেন, প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ শ্বাস নেয় কালো ধোঁয়ায়। বিদ্যুৎচালিত বাসে কার্বন নিঃসরণ প্রায় শূন্য। এটি শুধু শহরের পরিবেশ নয়, নাগরিক স্বাস্থ্যের দিক থেকেও অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

 

মূল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ২০২৫ সালে চারটি রুটে ইলেকট্রিক বাস চালু ও চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। ২০২৬ সালে অতিরিক্ত ১০০ বাস সংযোজন করা। ২০২৭ সালে দুটি চার্জিং ডিপো নির্মাণ করা। ২০২৮ সালে পুরোনো ডিজেলচালিত বাস অপসারণ শুরু করা। ২০২৯ ডিজিটাল টিকিটিং ও লাইভ ট্র্যাকিং সিস্টেমের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা। ২০৩০ সালে ৪০০ বাস ও তিনটি ডিপোসহ সব কাজ সম্পন্ন করা। এটি বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক দেবে ২ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ সরকার দেবে ৩৭৫ কোটি টাকা।