ঈদুল আজহার আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ডিসেম্বরে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। আবার কোনো কোনো দল জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারির কথা বলেছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে পবিত্র রোজা শুরু হবে। সে ক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে কিংবা জানুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে।
সেই বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দিন–তারিখ বলা হয়নি। ঈদের আগের রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়ে দিলেন, এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন নির্বাচন হবে।
এর মাধ্যমে সরকার হয়তো নির্বাচনের তারিখ বা রোডম্যাপ–সংক্রান্ত বিবাদ এড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু বিবাদ এড়ানো গেল না। চার মাস আগে নির্বাচন হলে যেমন ‘আকাশ ভেঙে’ পড়বে না, তেমনি চার মাস পর হলে ‘মহাপ্রলয়’ ঘটবে না। সমস্যা হলো কে কাকে ছাড় দেবে অথবা দেবে না।
সরকার মনে করছে, বিএনপি ও সমমনা দলগুলো তাদের (সরকারের) কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। আবার বিএনপির নেতৃত্ব ভাবছে, সরকার তাদের অগ্রাহ্য করে অন্যদের প্রতি পক্ষপাত করছে। এটাও অগ্রহণযোগ্য।
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা সরকার ঘোষণা করেছে। এখন এ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতাও তাকে সমাধান করতে হবে। কেন ডিসেম্বর, জানুয়ারি বা মার্চে নির্বাচন নয়, সে কথা ব্যাখ্যা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ব্যাখ্যা দিয়েছে।
২.
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পরও নির্বাচন নিয়ে সংশয় কাটেনি। কেবল নির্বাচন নয়, আরও অনেক বিষয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দল মুখোমুখি অবস্থানে। এটা গণতন্ত্রে উত্তরণের সহায়ক নয়।
ঈদের ছুটিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচনের বাইরে যে খবরটি বেশি আলোচিত হয়েছে, তা হলো প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকার চেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের চিঠি।
দ্য গার্ডিয়ান–এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ‘ভুল–বোঝাবুঝির’ অবসান করতে চান যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য ও সাবেক ‘সিটি মিনিস্টার’ টিউলিপ সিদ্দিক।
টিউলিপের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে বাংলাদেশে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ এনেছে কর্তৃপক্ষ। গত বছরের আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়।
এতে আরও বলা হয়, সংবাদমাধ্যমে টিউলিপের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ নিয়ে শোরগোল হয়েছে। এর মধ্যে টিউলিপ কিংবা তাঁর মায়ের (শেখ রেহানা) বিরুদ্ধে প্রভাব খাটিয়ে ৭ হাজার ২০০ বর্গফুটের প্লট নেওয়ার অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) রয়েছে। টিউলিপ অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর আইনজীবীদের মতে, অভিযোগগুলো ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ও ‘ভিত্তিহীন’।
টিউলিপ লিখেছেন, ‘আমি যুক্তরাজ্যের নাগরিক। লন্ডনে জন্মেছি। এক দশক ধরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড ও হাইগেটের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছি। বাংলাদেশে আমার কোনো সম্পদ বা ব্যবসায়িক স্বার্থ নেই। বাংলাদেশের প্রতি আমার হৃদয়ের টান রয়েছে। তবে এটা সেই দেশ নয়, যেখানে আমি জন্মেছি, বসবাস করেছি বা নিজের পেশাজীবন গড়ে তুলেছি।’
অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি লেখা চিঠিতে টিউলিপ আরও বলেন, ‘আমি জানি, আপনি নিশ্চয়ই বোঝেন, এমন প্রতিবেদন যেন আমার নির্বাচনী এলাকার জনগণ ও আমার দেশের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়, সেটি নিশ্চিত করা কতটা জরুরি।’
টিউলিপের দাবি, তিনি তাঁর খালার (শেখ হাসিনা) বিরোধীদের পরিচালিত একটি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কুৎসা অভিযানের’ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। গত মাসে বাংলাদেশে টিউলিপের বিরুদ্ধে পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, টিউলিপ সিদ্দিকের কোনো চিঠি তাঁরা পাননি।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর চিঠি পাক আর না পাক, তাঁকে (প্রধান উপদেষ্টা) লেখা টিউলিপের চিঠি সরকারের নৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করেছে। এত দিন আত্মগোপনে বা বিদেশে পলাতক থাকা আওয়ামী লীগের যে নেতারা অহরহ ইউনূস সরকারকে অবৈধ বলে প্রচার চালিয়ে আসছিলেন, এখন তাঁরা কী বলবেন?
৩.
ঈদের দ্বিতীয় দিন আরও দুটি কৌতূহলী ঘটনা ঘটেছে—১. রোববার রাত পৌনে দুইটার দিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানো। বিমান থেকে হুইলচেয়ারে তাঁকে নামানোর দৃশ্যও সংবাদমাধ্যমে এসেছে। সাবেক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ছিলেন ছোট ছেলে রিয়াদ আহমেদ ও শ্যালক ডা. নওশাদ খান। সাবেক রাষ্ট্রপতি সাধারণ যাত্রীর মতোই দেশে এসেছেন।
গত ৭ মে ভিআইপি লাউঞ্জ দিয়ে তাঁর দেশ ছাড়ার ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা ও বিক্ষোভ হয়েছিল। পরে তাঁর জেলা কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার ও ঢাকা বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে নিয়োজিত একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করা হয়।
উপপরিদর্শক ও সহকারী উপপরিদর্শক পদমর্যাদার দুজন কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
সাবেক রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা না নেওয়া প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘ইনভেস্টিগেশন (তদন্ত) হওয়ার পরে যে দোষী হবে, তাকে আইনের আওতায় নেওয়া হবে।’ এর আগে তিনি বলেছিলেন, প্রয়োজনে তাঁকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে নিয়ে আসা হবে। বাস্তবে তার প্রয়োজন হয়নি। তিনি নিজেই ফিরে এসেছেন।
আলোচিত দ্বিতীয়টি ঘটনা হলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেনের দেশত্যাগ। তিনি রোববার সকালে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দেশ ছেড়েছেন। ইমিগ্রেশন পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। শেখ হাসিনার শাসন আমলে আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়েছেন শেখ কবির। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ২৩টি প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের নানা পদে ছিলেন শেখ কবির।
শেখ কবিরের দেশত্যাগে বাধা না দেওয়া ও নির্বিঘ্নে সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশে ফেরা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা গুঞ্জন চলছে। আওয়ামী লীগের যেসব নেতা দমনপীড়ন চালিয়েছেন ও জুলাই–আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক—এটা সবারই দাবি। কিন্তু সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজীবী চিকিৎসকসহ শত শত পেশাজীবীর নামে ঢালাও হত্যা মামলা ও কাউকে কাউকে কারাগারে আটক রাখার যৌক্তিকতা নেই। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বেশ আগেই বাংলাদেশে নির্বিচার গ্রেপ্তার ও প্রতিশোধমূলক সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের নির্বিঘ্নে দেশে আগমন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চাচা কবির হোসেনের নির্বিঘ্নে বিদেশে যেতে দেওয়ার ঘটনাকে অনেকেই সরকারের নমনীয় মনোভাব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর মাধ্যমে কি সরকার নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টা বর্ণিত ‘যুদ্ধাবস্থা থেকে পরিত্রাণের’ উপায় খুঁজছে?