দিনাজপুর ব্যুরো প্রধান বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ রবিউল ইসলাম @ রাহুল দিনাজপুর সদর উপজেলার বিদুরসাহি তেলিপাড়া গ্রামের একজন ভাল ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে তার এলাকায় ব্যাপক পরিচয় রয়েছে।
দিনাজপুর সদর উপজেলার রানীগঞ্জে বিদুরসাহি গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী শহীদ রাহুলের বাবা মোঃ মোসলেম উদ্দিন এর সাথে তার বাড়িতে শহীদ পুত্র রাহুলের বিষয় জানতে চাওয়া হলে, তিনি গর্ব করে বলেন, আমার শহীদ পুত্র রাহুল একজন ভালো তরুন ফুটবল খেলোয়ার ছিল। সবে মাত্র আমার শহীদ পুত্র রাহুল গত ২০২২ সালে এসএসসি পাস করে দিনাজপুর সদর উপজেলা রানীগঞ্জ এহিয়া হোসেন স্কুল এন্ড কলেজে এইচএসসি পড়া-শোনা করছেন। আগামী বছর ২০২৫ সালে রাহুল এইচএস সি পরীক্ষা দিতো। কিন্তু কপালে সইলো না তার আগেই রাহুলকে এক নির্মম পরিহাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বুলেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে শহীদ হতে হয়েছে। শহীদ রাহুল একজন ভাল খেলোয়ার হতে চেয়েছিল। বাবার কাছে ছেলের স্বপ্ন পূরন হলো না, নিয়তির একি বিধান।
তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, গত ৪ আগস্ট সকালে কলেজে যাওয়ার কথা বলে রাহুল তার সহপাঠী একই এলাকার জহুরুল ইসলামের পুত্র জাহিদের সাথে বাড়ী থেকে বের হয়ে যায়।
তিনি বলেন, ওই দিন বিকেলে সাড়ে ৩ টায় তার মোবাইলে ফোন করে একজন জানায়, তার পুত্র রাহুল গুলি বিদ্ধ হয়েছে। তাকে দিনাজপুর শহরের কাচারি মোড়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাবার বুলেট ও টিয়ারসেল নিক্ষেপে গুরুতর আহত করেছে। তাকে আদালত এলাকার কর্মচারীরা উদ্ধার করে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেছে বলে তাকে সংবাদ দেয়।
ছেলে রাহুলের এই সংবাদ পেয়ে তিনি তার মেজো ছেলে আলামিনের মোটরসাইকেল যোগে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে আহত ছেলেকে দেখতে পায়। রাহুলকে হাসপাতালের চিকিৎসকরা তার শরীর থেকে ১৯ টি রাবার বুলেট বের করেছেন বলে তিনি জানতে পারেন। হাসপাতালে তার শরীরের ক্ষত স্থান গুলো ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে।
এরপর চিকিৎসকরা ওই দিন রাত প্রায় ৮টার সময় বলেন, দেশের অবস্থা ভালো না। আপনারা আপনাদের ছেলেকে বাসায় নিয়ে গিয়ে ওষুধ পত্র খাওয়ান, সে সুস্থ হয়ে যাবে। তার উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, এখন আর সমস্যা হবে না বলে চিকিৎসক উপদেশ দেন।
চিকিৎসকের পরামর্শে রাহুলকে তার শরীর থেকে বের করা ১৯ টি রাবার বুলেট সহ রাতেই বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।
রাহুলকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর, রাহুলের মা ফরিদা বেগম তার ৩ ছেলের মধ্যে সব ছোট ছেলে রাহুলের অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তার বড় ছেলে ফরিদুল ও মেজো ছেলে আলামিন এবং দুই পুত্রবধু সবাই মিলে আহত রাহুলের সেবা যতœ করতে থাকেন।
গত ৭ আগস্ট রাহুল একটু হাটা চলা-ফেরা করতে থাকেন। বাড়ির পাশে স্কুল মাঠে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়েছিল রাহুল। সেখান থেকে বাড়ি ফিরে এসে তার বাবা-মাকে বলেন, তার খুব কষ্ট হচ্ছে ও খারাপ লাগছে। বুকে প্রচ- ব্যথা হচ্ছে, সে বলে আমি সহ্য করতে পারছি না। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও, ডাক্তার দেখাও, আমি হয়তো আর বাঁচতে পারব না।
তার বাবা বলেন, গত ৭ আগস্ট সন্ধ্যায় একটি মাইক্রোবাস যোগে রাহুলকে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক রাহুলকে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দিয়ে ওই হাসপাতালে আই সি ইউতে ভর্তি করেন। ওই সময় রাহুলের শ্বাস-প্রশ্বাসে খুব কষ্ট হচ্ছিল বলে সে মুখে বলছিল। তাকে বাঁচানোর জন্য বাবা ও ভাইদের নিকট কান্না জড়িত কন্ঠে মিনতি করছিল।
হাসপাতালের আই সি ইউ ওয়ার্ডে ৯ আগস্ট পর্যন্ত রাহুল মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ওই দিন রাত সাড়ে ৯ টায় পৃথিবী ছেড়ে মৃত্যুর কোলে ঢেলে পড়েন।
রাহুলের মৃত্যুর সংবাদ চিকিৎসকেরা আধাঘন্টা পর তার পরিবারকে জানায়। হাসপাতালে নিয়ম কানুন শেষে ওই রাত সাড়ে ১১ টায় শহীদ রাহুলের মৃত্যুদেহ তার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।
রাহুলে বড় ভাই ফরিদুল জানায়, তার বাবা-মায়ের সব ছোট পুত্র এবং তারা বড় দু’ভাই এর আদরের একমাত্র ছোট ভাই রাহুল একজন নিষ্পাপ তরুণ। তাদের এলাকায় রাহুল সম্পর্কে কোন বদনাম নেই। সে লেখা-পড়ায় ভালো ছিল। দুই ভাই ও বাবা- মা মিলে রাহুলকে সাধ্যমত যতদূর সে পড়া-শুনা করতে পারে, তাকে পড়া-শুনার জন্য সব ধরনের উৎসাহ দেওয়া হতো। পড়া-শুনার পাশাপাশি রাহুল ভালো ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে এলাকায় ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছিল।
তার মা ফরিদা বেগম কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, তার ছেলে ফুটবল খেলে অনেক পুরুষ্কৃত হয়েছেন ও ট্রফি পেয়েছেন। তার খেলায় অর্জন করা ট্রফি ঘরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ফরিদা বেগম তার ছেলে শহীদ রাহুলের খেলাধুলা স্বীকৃতি ট্রফি হাতে নিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদেন বলে পরিবারের লোকজন জানায়। শহীদ রাহুলের দাদী হালিমা বেগম ৯০ বছর বয়সে নুইয়ে পরেছেন । তিনি বলেন, রাহুল ছোট বেলায় যখন তার মায়ের দুধ খাওয়া ছেড়েছে,তখন থেকে তার কাছেই থাকেন। সব ছোট নাতিকে এভাবে অকালে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ায় তিনি মানষিক ভাবে খুব আঘাত পেয়েছেন। তিনি বলেন, বয়সের এই প্রান্তে তার নিজের চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে তিনি বেঁচে আছেন, তার ছোট নাতি চলে গেলেন, বিধাতার কি রহস্য সেই জানেন। এভাবে আর যেন কোন দাদী ও মা-বাবার কোল খালি না হয়, সেজন্য তিনি সকলকে দোয়া করতে বলেন।
গত ১০ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০ টায় শহীদ রাহুলকে তার পরিবার, এলাকাবাসী, সহপাঠী এবং তার অধ্যায়নরত কলেজের শিক্ষকবৃন্দের অংশগ্রহনে শহীদের মর্যাদায় তার দাফন কার্য পারিবারিক কবরস্থানে সম্পূর্ণ করা হয়। তার দাফন ও নামাজে জানাযায় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, দল মত নির্বিশেষে কয়েক হাজার লোক উপস্থিত হয়ে ছিল।
এলাকাবাসীরা বলছেন, বৈষম্য বিরোধী কোঠা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে তার শহীদ এর মর্যাদায় মৃত্যু হয়েছে, সকলেই বিষয়টি স্বীকৃতি দেন। তার এই শহীদি মৃত্যু কোন দিন ব্যর্থ হবে না। যাদের রাবার বুলেট ও টিয়ারসেল নিক্ষেপে রাহুল শহীদ হয়েছে। তাদের উপযুক্ত বিচার ও শাস্তির দাবি জানান রাহুলের পরিবার ও এলাকাবাসী।
দিনাজপুর সদর উপজেলা রানীগঞ্জ এরিয়া হোসেন স্কুল এন্ড কলেজের প্রভাষক মোঃ নুরুল ইসলাম বলেন, রবিউল ইসলাম রাহুল একজন সৎ মেধাবী ও তরুণ ফুটবল খেলোয়াড়ের নাম। সে খুবই ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিল। তার ফুটবল খেলার কৃতিত্বে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম জড়িয়ে রয়েছে। এই কলেজ থেকে যেসব স্থানে রাহুলের অংশগ্রহণে ফুটবল খেলা হয়েছে, সব গুলো খেলাতেই সফল বিজয় অর্জিত হয়েছে।
তিনি বলেন, শহীদ রাহুলের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলার দ্বিতীয় স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্ম রাহুলকে ইতিহাস হিসেবে কৃতিত্বের সাথে স্মরণ করবেন। রাহুলকে অনুসরণ করে আগামী দিনের শিক্ষার্থীরা পথ চলার প্রেরণা পাবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
দিনাজপুর সদর কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ ফরিদ হোসেন জানান, এই মৃত্যুর ঘটনায় শহীদ রাহুলের বড় ভাই ফরিদুল ইসলাম বাদী হয়ে গত ২৭ আগস্ট দিনাজপুর কোতয়ালী থানায় একটি হত্যা মামলায় দায়ের করেছেন। ওই মামলায় সাবেক হুইপ ইকবালুর রহিম সহ আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের আসামী করা হয়েছে। মামলাটি তদন্তদিন রয়েছে।
