ইসরাইলে ইরানের হামলা

গেল কয়েক দশক ধরে ছায়াযুদ্ধেই লেগে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান ও ইসরাইল। এ সময় কেউ কারও ভূখণ্ডে সরাসরি হামলা করেনি। তবে শনিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে ইসরাইলি ভূখণ্ডে সরাসরি হামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে ইরান।

যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেকটা আগেভাগে বলে-কয়ে এই হামলা হয়েছে। ফলে তেমন কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে প্রকাশ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো দুই শত্রু দেশ। এসবের মধ্যে বাংলাদেশকে গাজায় ইসরাইলি হামলার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে এবং শান্তির পক্ষে থাকতে হবে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা।

  

যে প্রেক্ষাপটে হামলা

 

গেল ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরাইলি হামলার জবাবে এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ওই হামলায় ইসলামি বিপ্লবী বাহিনীর এক কর্মকর্তা নিহত হন।
 
রোববার ইসরাইলে সাড়ে ৩০০ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। এতে দক্ষিণ ইসরাইলের একটি সামরিক ঘাঁটি সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া সাত বছর বয়সী একটি শিশু মারাত্মক আহত হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। হামলা পাল্টা-হামলা বড় ধরনের আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে আশঙ্কা করা হয়েছে।
 
খবরে বলা হয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জর্ডান মিলে ইরানি ড্রোন ভূপাতিত করেছে। ইসরাইল যদি ইরানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়, তাহলে আরও বড় ধরনের হামলার হুমকি দিয়েছে ইরান।
 
তেহরানের শীর্ষ কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাগারি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘ইসরাইল যদি পাল্টা হামলা চালায়, তাহলে আমাদের জবাব হবে আরও কঠিন। আর যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরাইলি হামলায় সহায়তা করে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সামরিক ঘাঁটিগুলোকেও লক্ষ্যবস্তু বানানো হবে।’
ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রধান হোসেইন সালামি বলেন, ‘ইরানের স্বার্থের ওপর ইসরাইলি যে কোনো হামলার প্রতিশোধ নেয়া হবে।’
  

ছায়া থেকে বেরিয়ে প্রকাশ্য হামলা

 

এটি ছিল প্রথম ইসরাইলি ভূখণ্ডে ইরানের প্রথম কোনো নজিরবিহীন হামলা। তাই আকাশপথ বন্ধ ঘোষণা করেছিল ইসরাইল। তবে হামলার ধকল শেষ হতেই আকাশপথ খুলে দিয়েছে দেশটি।
 
হামলার বিষয়ে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমরা বিজয়ী হয়েছি। ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা প্রতিরোধ করেছি। সবার সহযোগিতায় আমরা বিজয়ী হবো।’
 
ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের ছায়াবাহিনীর ওপর নির্ভর করছে ইরান।
 
নাম প্রকাশ না করে এক সামরিক কর্মকর্তার বরাতে ইসরাইলি টেলিভিশন টুয়েলভ জানিয়েছে, ইরানি হামলার ভয়াবহ জবাব দেয়া হবে।
 
গত বছর ইসরাইলে হামলা চালায় হামাস। এক হাজার ২০০ ইসরাইলিকে হত্যা করে হামাস যোদ্ধারা। এছাড়া ২৫৩ অবৈধ দখলদারকে জিম্মি করা হয়েছিল। এরপর থেকে হামাসের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় অভিযান চালাচ্ছে ইসরাইল বাহিনী।
 
এরপর থেকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনার নতুন মোড় নিয়েছে। লেবানন ও সিরিয়া সীমান্তেও এই যুদ্ধের রেশ পড়েছে। সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরাকি সীমান্ত থেকে ইসরাইলি স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়।
গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ইসরাইলের সঙ্গে সংঘাত অব্যাহত রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র হিজবুল্লাহ আন্দোলনের। শনিবারও তারা ইসরাইলি সামরিক ঘাঁটিতে রকেট হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে। ইরান-ঘেঁষা হুতি বিদ্রোহীরাও ইসরাইলের বিরুদ্ধে ড্রোন হামলা চালিয়েছে বলে খবরে বলা হয়েছে।
 
এরআগে হামাসের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে লোহিত সাগরের জাহাজ চলাচলের পথে হামলা চালায় হুতিরা। এসব ঘটনার পর এখন ইরান-ইসরাইল সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে।
 
তবে সব পক্ষকেই সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে আঞ্চলিক শক্তি মিসর। ইরানি হামলাকে ‘গুরুতর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়াল হ্যাগারি। তিনি অভিযোগ করেন, ‘ইরান এ অঞ্চলকে সামরিক উত্তেজনার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’
  

ইসরাইলের আতঙ্ক বাড়ল

 

মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে জানতে চাইলে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘নেতানিয়াহুর অপসারণ ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করি। যদিও ইরানের হামলাকে তিনি নিজের বিজয় হিসেবে দেখছেন, কিন্তু প্রথমবারের মতো যুদ্ধে ইরান জড়িত হওয়ায় ইসরাইলের মধ্যে ভয় আরও বেড়ে গেছে স্বাভাবিকভাবে।’
 
বহু বছর ধরেই ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলছেন ইসরাইলি কট্টরপন্থী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। পরমাণু কর্মসূচি ও হিজবুল্লাহসহ বিভিন্ন মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে সমর্থন দেয়ার ঘটনায় তেহরানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিয়ে আসছেন।
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, এ হামলার ঘটনায় ভবিষ্যতে ইসরাইলে বসবাস করাই একটা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সেখানকার নাগরিকদের একটা আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করতে হবে।
 
তিনি বলেন, ‘এবার না হয়, অল্পতে গেল। কেউ মরলো না। কিন্তু ইরান ভালোভাবে দেখিয়ে দিল–দূর থেকে ইসরাইলে হামলা চালানোর ক্ষমতা তার আছে। এতে হিজবুল্লাহ ও হুতি বিদ্রোহীরা আছে। যে কারণে ভবিষ্যতে ইসরাইলে বসবাস করাই একটা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। একটা ভয়ের মধ্যে থাকতেই হবে।’
‘কারণ ইরানের শক্তি তো বাড়ছে, কমছে না। সেই হিসেবে, নেতানিয়াহুর বিদায় এবং এক ধরনের সমঝোতায় যদি আসতে পারে, সেটা হবে সবচেয়ে আদর্শ সিদ্ধান্ত। যদিও কোনো সন্দেহ নেই, ইসরাইলের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে গেল। এরআগে গেল বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলা চালিয়েছে হামাস। সেই আতঙ্কের রেশ এখনো কাটেনি,’ যোগ করেন এই অধ্যাপক।
 
ঢাবি শিক্ষক ইমতিয়াজ বলেন, ‘এখন কেবল ফিলিস্তিনি না, ইরানও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। আর ইরান জড়িত হওয়ার অর্থ হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশের জড়িত হওয়ার শঙ্কা। যেখানে ইসরাইলের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা আরও হুমকির মুখে পড়ল, সেখানে নেতানিয়াহুর টিকে থাকা আরও অসম্ভব।’
 
তিনি আরও বলেন, ‘নেতানিয়াহু তাড়াতাড়ি বিদায় হয় কি না, সেটা দেখা দরকার। তার বিদায়ে যিনি আসবেন, তিনিও তার চেয়ে কম হবেন কি না আমরা জানি না। কারণ, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় সম্পর্ক আছে। আমেরিকার জনগণ যতদিন বড় আকারের চাপ না দিতে পারে, সেটা দেখা দরকার।’
  

বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে?

 

ঢাবির এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমাদের পররাষ্ট্র নীতিতে পরিষ্কার–আমরা সার্বিকভাবে যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধ যাতে না হয়, সেটাই আমরা বলবো। আমরা চাই, তারা যেন শান্তির দিকে মনোযোগ দেন। ঠিকই একইভাবে আমরা বলবো, গাজায় জেনোসাইড যাতে বন্ধ করা হয় এবং বিচার যাতে হয়।’
 
তার মতে, ‘ফিলিস্তিনিদের পরিচয় ও স্বাধীনতা নিয়ে বাংলাদেশ খুবই পরিষ্কার। কাজেই মধ্যপ্রাচ্যে যাতে শান্তি ফিরে আসে, সেটাই তুলে ধরতে হবে বাংলাদেশকে।’
  

সাজানো হামলা!

 

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘পুরো হামলাটাই মোটামুটিভাবে জানিয়ে করা হয়েছে। যেখানে আমেরিকা জানত, ইসরাইলও জানত। তারপর হামলায় কোনো হতাহত হয়নি। তার মানে হচ্ছে, আন্তর্জাতিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাসে যে হামলা হয়েছে, আবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও এ ঘটনায় নিন্দা জানায়নি, সেই হিসাবে ইরানি জনগণের মধ্যেও একটা জনমত তৈরি হয়েছে যে ইরানের কিছু একটা করা দরকার।’
‘সেই হিসাবে ইসরাইলে এই হামলা চালানো হয়েছে। কোনো হতাহত নেই এবং সবাই জানতো। কারণ বিভিন্ন দেশের উড়োজাহাজ যাতে যেতে না পারে, এজন্য ইসরাইলের আকাশপথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। যেটাকে ইংরেজিতে বলা হয়, কোরিওগ্রাফ, অর্থাৎ সবাই জানত,’ যোগ করেন তিনি।
 
ঢাবির এই অধ্যাপক বলেন, ‘দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, ইসরাইল এখানে কী সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ দেশটি এরইমধ্যে বলেছে যে তাদের বিজয় হয়েছে। যেহেতু বড় আকারের অস্ত্রগুলো তারা ভূপাতিত করতে পেরেছে, তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি এবং আমেরিকাও সঙ্গে ছিল, কাজেই ইসরাইল ধরে নিয়েছে, তাদের বিজয় হয়েছে।’
 
এই আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘আবার বিজয় যদি হয়ে থাকে, তাহলে আপাতত ইসরাইলের পাল্টা আক্রমণ করার কথা না। আমার মনে হয় না, এখানে বড় আকারের যুদ্ধ আমরা দেখতে পাবো। কারণ, অর্থনৈতিক যে পরিস্থিতি, এই যুদ্ধের কারণে যে প্রভাব পড়বে, এরপর সামনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, এই হামলা বাইডেনের নির্বাচনকে কতটা সহায়তা করবে, তা নিয়েও প্রশ্নও রয়েছে।’
  

ইসরাইলকে সামরিক সহায়তার অজুহাত

 

ইরানের এই হামলাকে ইসরাইলকে সামরিক সহায়তা দেয়ার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তবে গাজায় জেনোসাইডের পরে ইসরাইলকে অস্ত্র না দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর থেকেই দাবি করা হয়েছিল।
 
ইরানের সঙ্গে কোনো সংঘাতে জড়ানোর ইচ্ছা নেই জানিয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেন, ‘তবে মার্কিন সামরিক বাহিনীকে সুরক্ষা ও ইসরাইলি প্রতিরক্ষায় সমর্থন দিতে কোনো দ্বিধা করবো না।’
 
 
এ নিয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘আমেরিকার কংগ্রেস যেহেতু নতুন অস্ত্র বিক্রির বিষয়ে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে, এই হামলার পরে সেই দ্বিধা আর থাকবে না। তাদের অস্ত্র বিক্রি করা সহজ হয়ে যাবে। সেই অস্ত্র বিক্রি, আর যুদ্ধের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। আবার মার্কিন কংগ্রেসেও ইসরাইলের পক্ষে সমর্থন বাড়বে।’
 
তিনি আরও বলেন, ‘মার্কিন জনগণের মধ্যেও ইসরাইলের প্রতি সমর্থন বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও মানুষ এতো বোকা না। সেই হিসেবে গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করেছেন, তারা কতটুকু সক্রিয় থাকবেন–সেটাও দেখা দরকার। তবে আমার মনে হয়, ইসরাইলকে যে প্রতিরক্ষা বাজেট বরাদ্দের কথা ছিল, সেটা অল্প সময়ের মধ্যে দিতে পারবে।’
  

অত্যাধুনিক অস্ত্রে হামলার শিকার ইসরাইল

 

গেল ছয় মাসে হামাস ও অন্য মিত্ররা ইসরাইলের বিরেুদ্ধে যেসব অস্ত্র ব্যবহার করছে, ইরানের অস্ত্র ছিল তার চেয়েও অনেক বেশি অত্যাধুনিক। বিশেষজ্ঞরা এমন দাবিই করেছেন।
 
এরআগে হামাস ও ইসলামিক জিহাদের আকাশপথের হামলা মোকাবিলা করেছে ইসরাইল। যার মধ্যে ছিল, স্বল্প পাল্লার রকেট এবং রাশিয়ান গ্র্যাড পরিবারের ১২২-মিলিমিটারের রকেট। এছাড়া সিরীয় এম-৩০২ রকেটও ছিল–যেগুলো সর্বোচ্চ ১০০ মাইল দূরত্বে হামলা চালাতে পারে।
 
হামাসের রকেটের মধ্যে ছিল, ফজর-৫। তারা ইরান থেকেই রকেট নির্মাণের এই প্রযুক্তি পেয়েছে। সর্বোচ্চ ৫০ মাইল দূরত্বে হামলা চালাতে পারে এই অস্ত্র।
রোববারের হামলায় ইরান ১৮৫টি ড্রোন, ৩৬ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও ১১০টি ভূমি থেকে ভূমিতে হামলা চালানোর ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। এছাড়াও ইরাক, ইয়েমেন থেকেও কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের দিকে ছুটে এসেছে।
বার্লিনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ইরানি সামরিক বিশেষজ্ঞ ফাবিয়ান হিনজ বলেন, ‘ইরান সম্ভবত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, যা ইসলামি বিপ্লবী বাহিনী নির্মাণ করেছে। পাবেহ ৩৫১ নামের এই ক্ষেপণাস্ত্র এক হাজার ২০০ মাইল পর্যন্ত আঘাত হানতে পারে। এমন অনেকগুলো ক্ষেপণাস্ত্র ইরান থেকে ইসরাইলে প্রবেশ করেছে।’
এছাড়া বিভিন্ন সংস্করণের ক্ষেপণাস্ত্র দেয়া হয়েছে হুতি বিদ্রোহী ও ইরাকি পপুলার মবিলাইজেশন ফোর্সকে। মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজরি বোর্ডের সদস্য জেফরি লুইস বলেন, ‘ভূমিতে হামলার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে ইরান, যা একসঙ্গে এক টনের মতো বিস্ফোরক বহন করতে পারে।’
ইরানি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের বেশিরভাগই ইসরাইলে হামলা চালাতে সক্ষম বলে জানিয়েছেন তিনি। জেফরি লুইস বলেন, ‘ক্ষেপণাস্ত্রের চেয়ে ইরানের ড্রোনগুলো কম বিস্ফোরক বহন করতে পারে। কিন্তু এগুলো আকাশে ভেসে থেকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে পারে।’
গেল কয়েক দশক ধরে ইরানের মূল আলোকপাত ছিল প্রতিরোধ, দীর্ঘ-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দিকে। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড়ো ক্ষেপণাস্ত্রে ভাণ্ডারের মালিক এখন ইরান। এছাড়া বৈশ্বিক বড়ো অস্ত্র রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে একটি পারস্য উপসাগরীয় দেশটি।
গেল বছরের অক্টোবরে হামাসের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যুদ্ধবিমানের মাধ্যমে নির্ভুলভাবে দূর থেকে হামলার বোমা চেয়েছে ইসরাইল। এছাড়াও আকাশপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোমের জন্য আরও ইন্টারসেপ্টরও চাওয়া হয়েছে। ইসরাইলের কাছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের আমলের ক্ষেপণাস্ত্র আছে, যেগুলোর ব্যর্থতার পরিমাণ অন্তত পনেরো শতাংশ।

 

ইরানের সামরিক সক্ষমতা

 

চিরবৈরী ইসরাইলে হামলার পর ইরানের সামরিক সক্ষমতার দিকেই সবার নজর এখন। তবে ইসরাইলি কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ইরানের যে কোনো হামলার জবাব দেয়া হবে।’
এতে ইরানের কাছ থেকেও পাল্টা প্রতিশোধ আসতে পারে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও দামেস্কে ইসরাইলি হামলার সঙ্গে নিজেদের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েক দশকে ইরানের প্রধান শত্রু প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সরাসরি ইরানি ভূখণ্ডে হামলা চালায়নি। তেহরানের জটিল সামরিক শক্তির সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চায়নি তারা। তেমন কোনো ইচ্ছাও তাদের নেই।
বিপরীতে আকাশ, ভূমি ও সাইবার মাধ্যমে দীর্ঘ ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে ইরান ও ইসরাইল। ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় গোপনে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। বিভিন্ন সময় ইরানের বিজ্ঞানী ও সামরিক কমান্ডারদেরও হত্যা করেছে তেলআবিব।
 
ইরানি সামরিক বিশেষজ্ঞ ও নেভাল পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্কুলের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সহযোগী অধ্যাপক আফসোন অস্তোভার বলেন, ‘সরাসরি ইরানে হামলা না চালানোর বেশ কিছু কারণ আছে। শত্রুরা ইরানকে ভয় পায় বলে হামলা চালাচ্ছে না—বিষয়টি ঠিক এমনও না। কিন্তু তারা জানেন, ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানে সেটা অনেক বেশি ভয়াবহ হবে।’
 
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ জানিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় সামরিক বাহিনী ইরানের। যার মধ্যে রয়েছে, অন্তত পাঁচ লাখ ৮০ হাজার সক্রিয় সেনা, দুই লাখ প্রশিক্ষিত রিজার্ভ সেনা এবং ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সদস্য।
 
সামরিক বাহিনী ও ইসলামি বিপ্লবী গার্ডের আলাদা স্থল, বিমান ও নৌবাহিনী রয়েছে। ইরানের সীমান্তের নিরাপত্তার দায়িত্ব ইসলামি বিপ্লবী গার্ডের। আর সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফরা সার্বিক কৌশল ও বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার সমন্বয় করেন।
 
এছাড়াও কুদস ফোর্স নামের আলাদা একটি বাহিনীর পরিচালনা করে বিপ্লবী গার্ডস। তাদের কাজ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিভিন্ন ছায়া মিলিশিয়াদের নেটওয়ার্ককে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেওয়া। এই পুরো বিষয়টিকে এক কথায় ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ বলা হয়।
 
ইরানের বাইরে মিলিশিয়া গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী, ইরাক ও সিরিয়ায় বিভিন্ন মিলিশিয়া গোষ্ঠী, ফিলিস্তিনের হামাস ও ইসলামিক জিহাদ।
 
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি হলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান কমান্ডার। বড় ঘটনাগুলোতে তার সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করা হয়।
 
বিশ্লেষকরা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ছায়া বাহিনীকে ইরানের মূল সশস্ত্র বাহিনীর অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। তাদের আঞ্চলিক মিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যারা সবসময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, যাদের হাতে ভারী অস্ত্র আছে এবং ইরানের প্রতি তারা অনুগত। ইরান যদি কখনো হামলার শিকার হয়, তখন তারা দেশটির পাশে দাঁড়াবে।
 
বার্লিনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের বিশেষজ্ঞ ফাবিয়ান হিনজ বলেন, ‘ইরান যে ধরনের সমর্থক ও ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, তা নজিরবিহীন। বিশেষ করে, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে ইরানের কাছে।’
  

কী ধরনের অস্ত্র আছে ইরানের

 

দীর্ঘদিন ধরে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলার এবং দূর-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে ইরান। তাদের হাতে অসংখ্য ড্রোন ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। নৌপথে স্পিডবোডের বিশাল বহর রয়েছে ইরানের। কিছু ছোটো ডুবোজাহাজ আছে, যেগুলো পারস্য উপসাগর ও হরমুজ প্রণালী দিয়ে নৌচলাচল ও বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে।
 
ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও আছে জাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। ইরানের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দুই হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত হামলা চালাতে পারে। ইসরাইলসহ মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো স্থাপনায় হামলা চালাতে সক্ষমতা আছে ইরানের।
 
দেশটির হাতে যে বিশাল ড্রোন ভাণ্ডার রয়েছে, তা এক হাজার ২০০ থেকে শুরু করে এক হাজার ৫০০ মাইল পর্যন্ত হামলা চালাতে পারে। এমনকি রাডার ফাঁকি দিয়ে উড়তে পারে এসব ড্রোন।
 
নিজের অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে ইরানের কোনো গোপনীয়তা নেই। সামরিক মহড়ার সময় নিজেদের ড্রোনভাণ্ডার প্রদর্শন করেছে তেহরান। বিশ্বজুড়ে ড্রোন রফতানির বিশাল উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে ইরানের। ইউক্রেন যুদ্ধে ইরানের ড্রোন ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছে রাশিয়া। সুদানের সংঘাতেও ইরানের ড্রোন ব্যবহার হতে দেখা গেছে।
 
দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ইরানের সামরিক স্থাপনা। ভূগর্ভেও অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তুলেছে দেশটি। যে কারণে আকাশপথে হামলা চালিয়ে এসব স্থাপনা সহজে ধ্বংস করা যাবে না।
  

ইরানের দুর্বলতা

 

ইরানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে বিমান বাহিনী। তাদের বেশিরভাগ বিমান শাহ মোহাম্মদ রেজা শাহ পাগলভির আমলের। ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইরান শাসন করেছেন।
 
এছাড়া যন্ত্রাংশের অভাবে ইরানের অনেক বিমান অকেজো পড়ে আছে। ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়া থেকে বিমানের ছোট্ট একটি বহর আমদানি করেছিল ইরান।
 
দেশটির ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানও মান্ধাতার আমলের, অল্প কয়েকটি নৌযান আছে। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে দুটি নৌযান আছে ইরানের—সাভিজ ও বেহসাদ। লোহিত সাগরে এ দুটি মোতায়েন করা হয়েছে। হামলার জন্য ইসরাইলি জাহাজ শনাক্ত করতে হুতি বিদ্রোহীদের সহায়তা করেছে এই দুই ইরানি নৌযান।
  

ইরানকে অস্ত্র দেয় কারা?

 

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ট্যাংক ও যুদ্ধবিমানের মতো আধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র ও সামরিক যন্ত্রপাতি আমদানি করতে পারে না মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। ১৯৮০ এর দশকে ইরাকের সঙ্গে আট বছরের যুদ্ধের সময় অল্প কয়েকটি দেশ ইরানকে অস্ত্র দিতে রাজি হয়েছিল।
 
১৯৮৯ সালে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হওয়ার পর অস্ত্রশিল্প নির্মাণে বিপ্লবী গার্ডস বাহিনীকে নির্দেশনা দেন আয়াতুল্লা আল-খামেনি। প্রতিরক্ষার জন্য বিদেশি অস্ত্রের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে চেয়েছিলেন তিনি।
 
সাঁজোয়া যান এবং নৌযান নির্মাণের চেষ্টা করেও তারা ভালো কিছু করতে পারেনি। উত্তর কোরিয়া থেকে ছোটো ছোটো ডুবোজাহাজ আমদানি করেছে ইরান। পাশাপাশি নিজেদের তৈরি ডুবোজাহাজের বহরকে আরও আধুনিক করে গড়ে তুলেছে।
 
তথ্যসূত্র: হারেৎস, রয়টার্স, নিউইয়র্ক টাইমস